বিশ্বসাহিত্যের এক কালজয়ী কথাশিল্পী কমরেড ম্যাক্সিম গোর্কির ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী আজ। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!
কিংবদন্তি এই সাহিত্যিক পরিবর্তনের বাঁকগুলো তুলে ধরেছেন নিখুঁতভাবে। মাত্র ১১ বছর বয়সে অনাথ হয়ে যান অ্যালেক্সি ম্যাক্সিসোভিচ পেশকভ। তিনি সেই বিখ্যাত রুশ লেখক, বিশ্বের কাছে যিনি পরিচিত ‘ম্যাক্সিম গোর্কি’ নামে। এ নামটি ছিল তাঁর ছদ্মনাম। তবে ছদ্মনামেই তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত। ‘গোর্কি’ শব্দের অর্থ হলো ‘তিক্ত’। এই নামকরণের পেছনে কারণ অবশ্য আছে- জীবনটাই ছিল তার কাছে তেতো, বিস্বাদময়।
১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ রাশিয়ার নিঝনি নভগোরোদে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ছিলেন বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। প্রথমে চিরতরে হারান বাবা ম্যাক্সিম পেশকভকে। বাবার মৃত্যুর পর গোর্কির আশ্রয় হয় মামার বাড়িতে। দাদির কাছেই তিনি বেড়ে ওঠেন গল্প শুনতে শুনতে। ভর্তি হন স্থানীয় স্কুলে। মা ভারভারা পেশকভা দ্বিতীয় বিয়ে করেন তাঁর চেয়ে ১০ বছরের ছোট এক অকর্মণ্য ব্যক্তিকে। পরের বিয়েটা মোটেও সুখের ছিল না। এর কিছুদিন পরেই ক্ষয়রোগে মারা গেলেন মা।
মায়ের হঠাৎ মৃত্যুর পর গোর্কির ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়ে দাদার ওপর। দাদা আর গোর্কির দায়িত্বভার নিতে চাইলেন না। মায়ের শেষকৃত্যের কয়েকদিন পরেই গোর্কিকে ডেকে স্পষ্ট বলে দেন, ‘তোমাকে এভাবে গলায় মেডেলের মতো ঝুলিয়ে রাখব তা তো চলতে পারে না। এখানে আর তোমার জায়গা হবে না। এবার তোমার দুনিয়ার পথে-প্রান্তরে বেরুনোর সময় হয়েছে।’
দাদার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর সেই শিশু বয়সেই গোর্কিকে চাকরি নিতে হয় একটি জুতার দোকানে। শহরের সদর রাস্তার ওপর এক শৌখিন জুতার দোকানের কর্মচারী হন তিনি। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম। পরিশ্রমকে তিনি মনে করতেন পুরুষের অলংকার স্বরূপ। একদিন দোকানের চাকরি ছেড়ে দিলেন তিনি। সে সময় জারের আমলে যাদের নির্বাসন দেওয়া হতো, তাদের নিয়ে যাওয়া হতো জাহাজে করে। সেই জাহাজের কর্মচারীদের বাসন ধোয়ার কাজ নেন গোর্কি। ভোর ৬টা থেকে মাঝরাত অবধি কাজ। তারই ফাঁকে ফাঁকে দুই চোখ ভরে দেখতেন নদীর অপরূপ দৃশ্য। দুই পারের গ্রামের ছবি। হিসাবপত্র মিটিয়ে হাতে আট রুবল নিয়ে ফিরে এলেন নিজের শহর নিঝনি নভগোরোদে। অবশেষে প্রিয়তম দাদির মৃত্যু গোর্কিকে করে তোলে চরম শোকবিহ্বল।
মাত্র ১২ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান নিরুদ্দেশে। জীবনের এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করেন আত্মহত্যার। ১৯ বছর বয়সে নদীর তীরে গিয়ে গুলি করেন নিজের বুকে। ঘটনাচক্রে বেঁচে যান তিনি। ঘটনাটি একটু বিস্তারিত জানা যাক, বিশ্ব যখন অস্থির সময় পার করছিল, ঠিক তখন রাশিয়ায় চলছিল জারের রাজত্বকাল। দেশজুড়ে চলছিল শাসনের নামে শোষণ অত্যাচার। বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েই গোর্কি পরিচিত হলেন কার্ল মার্কসের রচনাবলীর সঙ্গে। অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি, দর্শন, আরও নানা বিষয়ের বই পড়তে আরম্ভ করলেন তিনি। দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিছুদিন পর একটি রুটির দোকানে কাজ পেলেন। সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর অবধি একটানা কাজ করতে হতো তাকে। তারই ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন, বই পড়তেন।
বাস্তব জীবনের পরতে পরতে তিনি কষ্টকে, পরিশ্রমকে বন্ধুর মতোই দেখেছেন নিত্যসঙ্গী হিসেবেই। তাঁর এই সময়কার জীবনে অভিজ্ঞতার কাহিনী অবলম্বনে পরবর্তীকালে লিখেছিলেন বিখ্যাত গল্প ‘ছাব্বিশজন লোক আর একটি রুটি’। সেই রুটির কারখানায় কাজ করার সময় পুলিশের দৃষ্টি পড়েছিল তাঁর ওপর। সুকৌশলে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতেন গোর্কি। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে করতে মনের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তার ওপর যখন সন্দেহ-অবিশ্বাস; নিজের ওপরেই সব বিশ্বাসটুকু হারিয়ে ফেলতেন। মনে হতো এই জীবন মূল্যহীন, বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। এই মনে করেই তিনি বাজার থেকে কিনলেন একটি পিস্তল। ১৮৮৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর নদীর তীরে গিয়ে নিজের বুকে গুলি করলেন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জীবনের আশা ত্যাগ করলেও অদম্য প্রাণশক্তির জোরে বেঁচে যান গোর্কি।
এদিকে এক বৃদ্ধ বিপ্লবী মাঝেমধ্যে আসতেন সেই রুটির কারখানায়। সুস্থ হয়ে উঠতেই গোর্কিকে তিনি নিয়ে গেলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। ঘুরতে ঘুরতে এলেন নিজের ক্যাসপিয়ান সাগরের তীরে এক ছোট্ট শহরে। কোথাও বেশিদিন থাকতে মন চায় না। রেলে পাহারাদারির কাজ নিয়ে এলেন নিজের পুরোনো শহর নিঝনি নভগোরোদে। এই সময়ে কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন গোর্কি। নাম দেন ‘পুরোনো ওকের গান’। দুজন বিপ্লবীর সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর। সে জন্য পুলিশ তাঁকে বন্দি করল। কিন্তু যথাযথ প্রমাণের অভাবে কিছুদিন পর ছেড়ে দিল তাঁকে। প্রায় দুই বছর সেখানে রয়ে গেলেন তিনি।
ফিরে যাই, সেই শৈশবে। মাত্র ১২ বছর বয়সে পাঁচ বছর তিনি পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করেন রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গা। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বড় হয়েছেন তিনি। এ সময় বিভিন্ন চাকরির অভিজ্ঞতা ও নানা ঘটনার স্মৃতি তাঁর পরবর্তী সময়ের লেখালেখিতে প্রভাব ফেলে। জীবনে বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার অধিকারী গোর্কি চাকরি করতে গিয়ে কখনো হয়েছেন প্রহৃত, লাঞ্ছিত। অনেক সময় খাবারও জুটত না তার। এ তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকেই এমন ছদ্মনাম রাখা।
আগেই বলেছি, ম্যাক্সিম গোর্কির ছিল বই পড়ার প্রচুর নেশা। রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল বেশ। একদিন হাতে এল রুশ কবি পুশকিনের একটি কবিতার বই। একনিষ্ঠভাবে পড়লেন সেটি। পড়তে পড়তে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন তিনি। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে কারাবরণ করতে হয় একাধিকবার। কাটাতে হয় নির্বাসিত জীবনও। সেই গোর্কির সঙ্গে ১৯০২ সালে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ, যার ছদ্মনাম লেনিন, তার সঙ্গে গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত সখ্য।
আক্ষরিক অর্থে গোর্কি ছিলেন তাঁর নামের মতোই তিক্ত। তাঁর লেখায় সব সময় ফুটে উঠেছে তিক্ত সত্য। রাশিয়ার জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে সঞ্চিত রাগের প্রকাশ দেখা যায় তাঁর লেখায়। গোর্কির প্রথম বই ‘এসেস অ্যান্ড স্টোরিস’ প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ সালে। প্রথম বইটি সাড়া জাগিয়েছে সারা দেশে। লেখক হিসেবে ম্যাক্সিম গোর্কির জয়যাত্রা শুরু হয়। রাশিয়ার সমাজের নিচু স্তরের মানুষগুলোর জীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন তিনি। রাশিয়ার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বাঁকগুলো তিনি এঁকেছেন নিখুঁতভাবে।
শ্রমিকদের সঙ্গে গোর্কির ছিল ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক। ১৯০২ সাল থেকে গোর্কি ছিলেন লেনিনের ঘনিষ্ঠতমদের একজন। ১৯০০ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত গোর্কির লেখায় আশাবাদের ব্যঞ্জনা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ১৯০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান তিনি। সেখানে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত কালজয়ী উপন্যাস ‘মা’। ১৯০৬ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত গোর্কি ছিলেন ক্যাপ্রিতে। ১৯১৩ সালে সাধারণ ক্ষমার আওতায় তিনি আবার ফিরে আসেন রাশিয়ায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গোর্কির ঘরটি হয়ে উঠেছিল বলশেভিকদের অফিসঘর। রুশ বিপ্লবের পর গোর্কি ছিলেন ইতালিতে। ১৯৩২ সালে স্টালিনের আহ্বানে গোর্কি রাশিয়ায় ফিরে আসেন। তাকে ভূষিত করা হয় অর্ডার অব লেনিন উপাধিতে।